আব্দুল বায়েস
বাংলাদেশ এখন চলছে এক অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধানে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। টানা ১৫ বছর দেশ শাসনের পর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। নির্বাপিত হয় এক উন্নয়ন বয়ান, যেখানে অভিযোগ আছে, ছিল আয় ও সম্পদে ব্যাপক বৈষম্য, অপহৃত হয়েছিল বাকস্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার।
প্রকৃতপক্ষে ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা থাকলে
উন্নয়ন আপনা-আপনি এসে ধরা দেয়।
কারণ উন্নয়নের কারিগর জনসাধারণ, সরকার নয়, যদিও সহায়ক। থাক সে কথা।
সন্দেহের অবকাশ নেই যে সদ্যঃসমাপ্ত ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি এক কঠিন সময় পার করেছে—কেউ বলবে ক্রান্তিকাল। বলা বোধ করি ভুল নয় যে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে এমন তোলপাড় দেখা যায়নি।
অর্থনৈতিক ‘মেহেম’ যাকে বলে। আর্থিক খাতে জেঁকে বসা নৈরাজ্য ও লুটপাট, জনজীবনে নাভিশ্বাস তোলা মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভে ব্যাপক ধস, আমদানি-রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা ইত্যাদি গোটা অর্থনীতিকে গ্রাস করে। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা যে চলেনি, তা নয়। কিন্তু ভুল নীতির বাস্তবায়নের জন্য পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছিল।
এর মধ্যেই যোগ হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের লড়াই : জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান—দিয়াশলাইয়ের কাঠি থেকে বন উজাড়! স্মর্তব্য যে এর আগে দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতির কারণে প্রায় তিন বছর মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট ছিল দেশের সাধারণ মানুষ।মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল গত বছরের জুনে—নীতি সুদ হার উন্নীত করা হয়েছে ১০ শতাংশে। তার পরও মূল্যস্ফীতি না কমে উল্টো নভেম্বরে এসে ১১.৩৮ শতাংশ ছুঁয়েছে। আর খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি উঠেছে ১৩.৮০ শতাংশে। অতি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রভাবে মূল্যস্ফীতি তো কমেনি, বরং বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছে।
শ্রমিক অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা চলছে দেশের তৈরি পোশাক খাতসহ সব শিল্পে।
দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য চরম সংকটে, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তা যে অতীতের ধারাবাহিকতায়, তার সঙ্গেও দ্বিমতের অবকাশ খুব কম। সম্পদ ও অর্থ লুটপাটের জেরে বিদায়ি বছরের প্রথমার্ধে ফোকলা অর্থনীতির গতি ছিল টালমাটাল—জিডিপির প্রাক্কলন ৫.২৫ শতাংশের বিপরীতে আইএমএফের পূর্বাভাস ৩.৮ শতাংশ; টাকার সঙ্গে ডলারের অবমূল্যায়ন ১২ শতাংশ, ১৫ শতাংশ ঋণের সুদের চাপে ব্যবসা খাদের কিনারে, ২৪০ বিলিয়ন ডলার পাচার।
অভিজ্ঞমহলের ধারণা, আগামী দুই বছর অর্থনীতিতে তিন ধরনের ঝুঁকি থাকবে—মূল্যস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য। ২০২৪ অর্থবছরে প্রকৃত জিডিপি আগের বছরের প্রায় ৬ থেকে ৫ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২৫ অর্থবছরে সেটি ৪ শতাংশে নামবে বলে প্রাক্কলিত। পড়ন্ত এই প্রবৃদ্ধির পেছনে কাজ করবে সংকুচিত বিনিয়োগ ও শিল্প খাতের কর্মকাণ্ড। যা হোক, পিছু টানার ঝুঁকিগুলো দৃষ্টি এড়ায় না; যেমন—মূল্যস্ফীতির অব্যাহত চাপ, বাংলাদেশের বড় বড় রপ্তানি বাজারে সংকুচিত চাহিদা এবং আর্থিক খাতের নাজুকতা ইত্যাদি প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
বলা বাহুল্য যে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রত্যাশা তৈরি করে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল তৎকালীন সরকারের পতনে তীব্রতর হয়ে ওঠে অর্থনীতি জনকল্যাণমুখী হয়ে ওঠার প্রত্যাশা। কিন্তু গেল পাঁচ মাসে একমাত্র ব্যাংকিং খাতের জন্য কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি। এখনো আইএমএফের দর্শনেই চলেছে দেশের অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নীতিগত কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না এখনো।
আন্তর্জাতিক এই প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ঋণ পেতে যেসব শর্ত গিলতে হচ্ছে, তা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রাখবে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অন্তত অতীতের অভিজ্ঞতা এর পক্ষে সায় দেয় না।
আরো তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। অভিযোগ আছে যে ‘বিগত সময়ের সুবিধাভোগীরাও এখন আস্তে আস্তে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে। আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়ে গেছে এখনো। এখনো কার্যকর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত বাজেট। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের মূল আলোচনাটি তৈরি হয়েছিল বৈষম্য দূর করাকে কেন্দ্র করে, যদিও বৈষম্য দূর করে অর্থনীতিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়নি এখনো।’ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন যথার্থই বলেছেন, দুটি বিষয় খুবই জরুরি। প্রথমত, খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রধান প্রধান নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর দিতে হবে। সরবরাহ, লেনদেন, প্রতিযোগিতা—এসবের সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে বাজার মনিটর করতে হবে। সরবরাহ চেইনে কোথায় মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তা চিহ্নিত করতে হবে এবং তার প্রতিকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনীতি সচল করা কঠিন হবে।
দুই.
২০২৫ সালের বৈশ্বিক অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত. যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট এবং তার সরকারের মতিগতির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। প্রাক্কলন করা হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও পণ্যের দাম অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল বা নিম্নমুখী থাকবে। তবে বৈশ্বিক স্তরের এই সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু সুবিধা করতে পারবে, তা মূলত নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ দুটি বিষয়ের ওপর। এক. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন নিয়ে সন্দেহ অনেকের। আর রাজনৈতিক অরাজকতা, মানে অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা। অস্বীকার করার উপায় বোধ হয় নেই যে বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অনিশ্চয়তা বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে প্রবল ব্যাহত করছে। বিভিন্ন উৎসর পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধি নিচের দিকে দেখানো হচ্ছে। এমনিতেই গেল পাঁচ মাসে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি, প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। দ্বিতীয়ত, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষণও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
সম্ভবত ২০২৫ সাল হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। এর প্রধান কারণ, সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে হলে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। আর মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে বিনিয়োগ বাড়িয়ে অর্থনীতি সচল রাখতে হবে। এদিকে আবার বিনিয়োগ বাড়াতে হলে লাগবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আবার মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিক পর্যায়ে না এলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। এমন দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছে অর্থনীতি। এই দুষ্টচক্রের মধ্যেই এলো নতুন বছর ২০২৫ সাল।
সুতরাং মূল্যস্ফীতি কমানো, বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান বাড়ানো, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রাখা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখা, ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরানোসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আশা করা যায়, ২০২৫ সালে যে করেই হোক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। তা না হলে নিম্ন প্রবৃদ্ধির চক্রে আটকা পড়ে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনাটুকু হারাতে পারে, যা আমরা কেউই চাই না। আমরা চাইব মূল সংস্কার সম্পাদন এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সাপেক্ষে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা। ২০২৫ সাল আমাদের সবার জন্য মঙ্গলময় হোক, ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশের অর্থনীতি, নিশ্চিত হোক বৈষম্যহীন সমাজ—এই কামনা দেশবাসীর। মনে রাখতে হবে, পুরনো রেকর্ড বাজিয়ে বোকা বানিয়ে মানুষকে যে বেশিদিন শান্ত রাখা যায় না, তার প্রমাণ জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
ঢাকা -বাংলাদেশ।