যশোরের চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পায়েল হোসেনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ঝড় ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। মাত্র দেড় মাসের মধ্যে নানা দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এই পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এখন শিরোনামে। নারী কেলেঙ্কারি, ঘুষ-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, নিরীহ মানুষকে হয়রানি—এমন একাধিক গুরুতর অভিযোগে বিপাকে পড়েছেন তিনি।
পায়েল হোসেনকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার ঘটনায় ক্লোজড করা হয়েছে। পুলিশ সুপারের নির্দেশে গত রোববার (২৯ ডিসেম্বর) তাকে যশোর পুলিশ লাইনসে ক্লোজড করা হয়। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মাত্র দেড় মাস আগে চৌগাছা থানায় যোগদান করা এই ওসির বিরুদ্ধে টর্চার সেল পরিচালনা, ঘুষ ও রিমান্ড বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, নিরীহ মানুষকে হয়রানি এবং নারী কেলেঙ্কারির মতো নানা অভিযোগ উঠেছে। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) রাতে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে তাকে এক নারীর সঙ্গে অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করতে দেখা যায়। এই ভিডিওটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
তথ্য মতে, ওসি পায়েল হোসেন ১৭ নভেম্বর ঢাকার রমনা থানা থেকে বদলি হয়ে চৌগাছা থানায় যোগদান করেন। সূত্রের দাবি, তিনি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে সীমান্তবর্তী উপজেলা যশোরের চৌগাছা থানার ওসির পদে আসীন হন। এই টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।
চৌগাছা থানায় দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম অভিযানেই তিনি চৌগাছা বাস মালিক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিনের বাড়ি সারা রাত অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং ১ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় জসিম উদ্দিনকে একাধিক মামলায় আসামি করা হয়। এছাড়া, ভাদড়া গ্রামের ব্যবসায়ী মানিক হোসেনকে থানায় না নিয়ে নিজের বাংলোতে আটকে শারীরিক নির্যাতন চালানোর পর ৫ লাখ টাকা আদায় করেন এবং অস্ত্র মামলায় তাকে রিমান্ডে পাঠান।
মাসিলা গ্রামের পারভেজ আহমেদ সোহাগ নামক এক যুবককে ৩২ ঘণ্টা আটকে রেখে ইলেকট্রিক শক দিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগও ওঠে। এরপর তাকে ডাকাতি ও মাদক মামলায় আসামি দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়। ২৩ নভেম্বর, সিংহঝুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হামিদ মল্লিককে গ্রেফতার করে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন ওসি পায়েল। টাকা না দেওয়ায় তাকে চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে পাঠানো হয়।
১৭ ডিসেম্বর চৌগাছা বাজারের ব্যবসায়ী জীবন হোসেন লিপু ও তার বন্ধু বাবুলের ছোট ভাই হারিয়ে গেলে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। দুইদিন পর ওসি তাদের জানিয়ে দেন, হারানো ব্যক্তিকে উদ্ধারে অতিরিক্ত এসপির জন্য ২ লাখ টাকা লাগবে। নিরুপায় হয়ে বাবুল ৫০ হাজার টাকা দেন, কিন্তু পরে হারানো ব্যক্তি নিজেই উদ্ধার হলে, ওসি টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদের চৌগাছা ছাড়তে বাধ্য করেন।
সবশেষ ২৮ ডিসেম্বর, একটি ৫ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের ভিডিও ভাইরাল হয়, যাতে ওসি পায়েল মোবাইলে কথা বলছেন এবং এক নারীর সঙ্গে অশালীন অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করছেন। এছাড়া, ওই নারীর সঙ্গে আরও তিনটি অশালীন অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে।
ভুক্তভোগী নারী গণমাধ্যমকে জানান, তিনি তালাকপ্রাপ্ত এবং এই সুযোগে ওসি তাকে ফোন করে থানায় ডাকতেন এবং বিভিন্ন সময়ে তার লালসা চরিতার্থ করার জন্য চাপ দিতেন।
তবে ভাইরাল হওয়া ভিডিও এবং অডিও ক্লিপ নিয়ে ওসি পায়েল হোসেনের দাবি, তাকে ট্র্যাপে ফেলা হয়েছে এবং তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
যশোর পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ওসি পায়েলের কর্মকাণ্ডে পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) রুহুল আমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’