আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে জুলাই-আগস্টে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ আসামির বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বে দায়) অভিযোগ আনা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। পরে অভিযোগটির তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সাবেক বিচারক ও সচিবসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারাগারে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গতকাল যে ১৩ জন আসামিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান, দীপু মনি, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক প্রধানন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম। গ্রেপ্তার থাকা আরেক আসামি সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইলে একটি মামলায় পুলিশ হেফাজতে থাকায় তাকে উপস্থিত করা হয়নি।
গতকাল কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে দুটি প্রিজন ভ্যানে করে ১৩ আসামিকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। পৌনে ১১টার দিকে তাদের এজলাসে তোলা হয়। ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক এজলাসে উপস্থিত হলে বেলা ১১টার দিকে শুনানি শুরু হয়। এ সময় প্রসিকিউটরের নেতৃত্বে
প্রসিকিউশনের সদস্যদের পাশাপাশি আসামিদের পক্ষে কয়েকজন আইনজীবীকে ওকালতনামা দাখিল করতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী, আজিজুল হাসান দুলু, মো. আবুল হাসানসহ আরও কয়েকজন ছিলেন।
এ সময় ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছি, ডিফেন্স পক্ষে এহসানুল হক সমাজী ওকালতনামা জমা দিয়েছেন। আমি অনানুষ্ঠানিকভাবে জানতে পেরেছি, উনাকে (সমাজী) রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। দুয়েক দিনের মধ্যেই হয়তো সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তাই তিনি আসামিপক্ষে শুনানি করলে এটা হবে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’। তাজুল ইসলাম আসামিপক্ষে শুনানি না করতে আইনজীবী সমাজীকে অনুরোধ জানান।
এ সময় এহসানুল হক সমাজী বলেন, চিফ প্রসিকিউটর যে বিষয়টি তুলেছেন, তা আমার জানা নেই। যেহেতু তিনি একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, আমি আপাতত শুনানি করব না। আইনজীবী সমাজী পাঁচ আসামির পক্ষে এসেছিলেন বলেন জানান। তারা হলেন- আনিসুল হক, শাজাহান খান, ফারুক খান, রাশেদ খান মেনন, কামাল আহমেদ মজুমদার ও তৌফিক-ই-ইলাহী। আসামিদের পক্ষে তিন আইনজীবী ওকালতনামা দাখিল করলেও কোনো বক্তব্য রাখেননি। তবে ফারুক খান ও তৌফিক ইলাহীর আরেক আইনজীবী আজিজুল হাসান দুলু আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের অনুলিপি সরবরাহের আবেদন জানান। তখন প্রসিকিউশনকে সব আসামির আইনজীবীদের তা সরবরাহ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালের কাছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ঘিরে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃস্থানীয় নির্দেশে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটের নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা কর্মকা- ছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী নানা ‘অপরাধের’ বিষয়ে তদন্ত সংস্থার একটি প্রতিবেদন বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করেন। তাজুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ সাল থেকে একটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ এবং পারিবারিকীকরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দেশকে একটা ফ্যাসিবাদী ও নিপীড়ক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল। একটা রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সময় হত্যা করে, পিলখানা হত্যাকা-ের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। শাপলা চত্বরে হত্যাকা-ের মাধ্যমে প্রতিবাদী জনতাকে স্তব্ধ করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে মানুষের বাকস্বাধীনতা, অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে ভয়েস, সেটাকে রুদ্ধ করা হয়।
প্রধান আসামি শেখ হাসিনার ওপর সমস্ত অপরাধের বড় দায় পড়ে দাবি করে তাজুল বলেন, তার নির্দেশে তাকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যে ১৩ জনকে উপস্থিত করা হয়েছিল, তারা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে, সরকারি দলের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থেকে, আমলাতন্ত্রের মধ্যে থেকে, সংসদ সদস্য এবং ১৪ দলের নেতা, সবাই মিলে নৃসংশভাবে অপরাধ করেছেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমাতে সরকারি বাহিনী ও তাদের সহযোগিদের দ্বারা দেড় হাজারের অধিক ছাত্র-তরুণ-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত তিনি তুলে ধরেন। পাশাপাশি জুনাইদ আহমেদ পলকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন ইন্টারনেট বন্ধ করায় বিষয়টি আদালতের সামনে উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়া টকশোতে সাবেক বিচারপতি মানিকের দেওয়া বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর।
তাজুল ইসলাম বলেন, শুধু জুলাই-আগস্টেই কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়নি, বরং বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গুম, খুন এবং আয়না ঘরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে এসবের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে।
যে ১৩ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে ‘মোটাদাগে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ দায়ে তারা অভিযুক্ত মন্তব্য করে তাজুল ইসলাম বলেন, কারণ তারা নির্দেশ দিয়েছেন, পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, সরাসরিও জড়িত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। আন্তর্জাতিক আইনে প্ররোচনা দেওয়া, পরিকল্পনার সঙ্গে থাকা, যারা সরাসরি অংশ নিয়েছে তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শাস্তি না দেওয়া- এগুলো অপরাধ। এ অপরাধের দায় প্রত্যেক আসামির ওপর আছে। শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আমলাসহ আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের নেতাদের ওপর এর দায় পড়ে।
এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত শেষ করতে আদালতে সময় প্রার্থনা করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তখন ট্রাইব্যুনাল জানতে চান- ‘শেখ হাসিনা কোথায়।’
জবাবে তাজুল ইসলাম বলেন, ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের দিন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে, সে চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিতে ভারতকে জানানোর ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে আদালতকে জানান। এ সময় মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২ মাস সময় চেয়ে প্রসিকিউশনের আবেদনে এক মাস সময় দিয়ে আগামী ১৭ ডিসেম্বর পরবর্তী তারিখ ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিন গ্রেপ্তার থাকা আসামি এবং এ মামলায় পরোয়ানার আওতায় থাকা অন্য আসামিদের গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের শুনানি শেষ হলে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও ফারুক খানের পক্ষে আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু শুনানি করতে চান। এ সময় শুনানি করার আগে বিচারকদের কাছে শুনানি করতে যে আবেদন দেওয়া হয়, সেই আবেদন না থাকার বিষয়টি চিফ প্রসিকিউটর আদালতের নজরে আনেন।
আদালত আইনজীবীকে বলেন, আবেদন ছাড়া কি শুনানি করা সম্ভব? জবাবে আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন, আদালত চাইলে সম্ভব, যদি অনুমতি দেওয়া হয়, আমি শুনানি করতে চাই। এ সময় আদালত তাকে শুনানি করতে নিষেধ করেন। এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রীসহ ১৩ আসামির পক্ষে কোনো শুনানি হয়নি।
পরে আইনজীবী আবুল হাসান আসামিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এবং পরিবারের সদস্যদের দেখা করার জন্য আদালতের কাছে মৌখিক অবেদন করেন। তখন আদালত শৃঙ্খলা রক্ষা করে রেজিস্ট্রারের তত্ত্বাবধানে আসামিদের সঙ্গে দেখা করা এবং কথা বলার অনুমতি দেন ট্রাইব্যুনাল।
শুনানি শেষে চিফ প্রসকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বিগত সরকারে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, তাদের মধ্যকার ১৩ জনকে আজ অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। আগামী দিনে যারা ফ্যাসিস্ট হতে চান, তাদের জন্য আজকের দিনটি এক শিক্ষার দিন।
তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ, দলীয়করণের মাধ্যমে একটি নিপীড়ক সংস্থায় পরিণত করা হয়েছিল, সে স্টোরি আমরা আদালতে তুলে ধরেছি। জুলাই অভ্যুত্থানে ৫৬ হাজার বর্গ মাইলজুড়ে টার্গেট করে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এর তদন্ত সমাপ্ত করে বিচারের উপযোগী একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে আমরা দুই মাস সময় চেয়েছিলাম, আদালত এক মাস সময় মঞ্জুর করেছেন।
আদালতে বিচারিক কার্যক্রম শেষ হলে আসামিপক্ষের আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনদের এজলাস কক্ষে দেখা করার জন্য কিছু সময়ের অনুমতি দেওয়া হয়। দুপুর দেড়টায় প্রিজন ভ্যানে করে আসামিদের আদালত থেকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে যে ৪৬ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানা জারি করেছিল, তাদের মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়াও তার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তার দুই ভাতিজা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ রয়েছেন। পরোয়ানা জারি হয়েছে সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত ও অধ্যাপক জাফর ইকবালের বিরুদ্ধেও। তাদের মধ্যে সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনসহ পুলিশ ও র্যাবের কয়েককজন কর্মকর্তা রয়েছেন।