২৯শে এপ্রিল, ২০২৫

মাদকের করাল গ্রাস: বাংলাদেশে যুবসমাজ হুমকির মুখে, প্রশাসনের তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ

মাদকের করাল গ্রাস: বাংলাদেশে যুবসমাজ হুমকির মুখে, প্রশাসনের তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ
ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার দেশের যুবসমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে মাদক ব্যবসা ও ব্যবহারের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একাধিক অভিযান চালালেও, মাদক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে তেমন সফলতা অর্জন করতে পারছে না। ফলে তরুণ প্রজন্ম মাদকের ভয়াবহতা এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধের চক্রে আটকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পুলিশের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে মাদক চোরাচালান ও ব্যবহারের হার প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো, মাদকের প্রধান ভোক্তা হিসেবে যুবসমাজকে টার্গেট করা হচ্ছে। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা এবং অন্যান্য সিন্থেটিক ড্রাগগুলো স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিস্তৃত হয়ে পড়ছে।

মাদক চোরাচালান ও ব্যবসার নেটওয়ার্ক
বাংলাদেশে মাদক প্রবেশের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো। বিশেষত মিয়ানমার থেকে ইয়াবার প্রবাহ ক্রমশই বেড়ে চলেছে। কক্সবাজার, টেকনাফ এবং বান্দরবানের মতো সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে মাদক ব্যবসায়ীরা সক্রিয়ভাবে মাদক পাচার করে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিশ ও র‍্যাব (র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) বিভিন্ন সময় মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার পিস ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকদ্রব্য আটক করলেও, মাদক ব্যবসায়ী চক্রগুলোর মূল নেতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা প্রতি সপ্তাহেই মাদকবিরোধী অভিযান চালাই এবং অনেক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করি। তবে মাদক ব্যবসার নেটওয়ার্ক এত শক্তিশালী যে গ্রেফতারের পরেও নতুন নতুন চক্র গড়ে উঠছে।”

মাদকের সামাজিক প্রভাব
মাদকের বিস্তৃতি কেবল অপরাধ বৃদ্ধি করছে না, বরং এটি সমাজের বুনিয়াদকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তরুণরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে তারা তাদের লেখাপড়া এবং কর্মজীবন থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। অনেক পরিবার মাদকের কারণে ভাঙছে, এবং মাদকাসক্তরা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও, মাদক গ্রহণের ফলে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রুবানা হক বলেন, “মাদকের ফলে তরুণরা সহজেই হতাশা, মানসিক অবসাদ এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এটি শুধুমাত্র তাদের নিজেদের নয়, পুরো সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”

মাদকাসক্তির ফলে সাম্প্রতিক সময়ে মাদকজনিত সহিংসতার ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত রাজধানী ঢাকায় বেশ কিছু খুন, ছিনতাই এবং লুটপাটের ঘটনায় মাদকাসক্ত তরুণদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। মাদকসেবীরা নিজেরা সহিংস আচরণে লিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চ্যালেঞ্জ
মাদকবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত তৎপর থাকলেও, মাদকের নেটওয়ার্ক ভাঙতে প্রশাসনকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালান বন্ধ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ পাচারকারীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করছে। এছাড়া, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এই তৎপরতার অংশ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

র‍্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা জানি যে মাদক ব্যবসার সঙ্গে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। তবে তাদের ধরার প্রক্রিয়া খুবই জটিল। অনেক সময় রাজনৈতিক এবং সামাজিক চাপে আমাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।”

এছাড়াও, মাদকসেবীদের মধ্যে বেশিরভাগই অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আইন অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক মাদকসেবীদের সংশোধনাগারে পাঠানো হয়, যা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয় বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

মাদক প্রতিরোধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা
মাদক সমস্যার সমাধান কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর নির্ভর করে নয়, বরং পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। তরুণদের মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদকবিরোধী কার্যক্রম এবং কাউন্সেলিং চালানো উচিত বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।

মাদকবিরোধী আন্দোলনের একজন কর্মী শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের শুধু মাদক ব্যবসায়ীদের ধরলেই চলবে না, বরং মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন ও তাদের পরিবারের সঙ্গে নিবিড় সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে।”


গুরুত্বপূর্ণ দিক:

  • মাদক চোরাচালানের প্রধান রুট: মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত।
  • মাদকের সবচেয়ে বড় ভোক্তা: ১৫-৩০ বছর বয়সী তরুণরা।
  • ইয়াবা, ফেনসিডিল এবং গাঁজা হলো দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মাদক।
  • আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান সত্ত্বেও মাদক চক্র সক্রিয়।
  • মাদকের বিরুদ্ধে সমাজে ব্যাপক সচেতনতা এবং পুনর্বাসনের প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন