দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, ট্রাফিক আইন অমান্য করা ও দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এর পেছনে প্রধানতম দায়ী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৬ হাজার ৫২৪ নিহত এবং ১১ হাজার ৪০৭ জন আহত হয়েছেন। সেখানে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৫৯৮ জন মারা গেছেন। আর আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৬০ জন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ২০২২ সালে, ৭ হাজার ৭১৩ জন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে, যা মোট জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। এটা শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আর্থিক ক্ষতির হিসাব। কিন্তু একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি যদি কোনো পরিবারের মারা যান, তাহলে পুরো পরিবার ধ্বংস। সেক্ষেত্রে আহত ও নিহত ব্যক্তি ও নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া একটা বড় ধরনের সহযোগিতা। এ লক্ষ্যে ২০২২ সালে একটি আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন করা হয়। প্রতিটি মোটরযান মালিককে এ তহবিলে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয়।তহবিল গঠনের পর থেকে এ তহবিলে জমা পড়েছে প্রায় ২২১ কোটি টাকা। তবে এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিতরণ হয়েছে মাত্র ২৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ৫৬৬ জন।
সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ ও সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০১২-এর আলোকে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া শুরু হয় ২০২৩ সালের শুরু থেকে। বিআরটিএর তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ২১ হাজার ৭৯৮। কিন্তু একই সময়ে মাত্র ৫৬৬ জনকে আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে বিআরটিএ। ক্ষতিপূরণ পাওয়া ব্যক্তির মধ্যে ৪৮৩ জন নিহত ব্যক্তির উত্তরসূরি। ৮৩ জন ছিলেন আহত ব্যক্তি। তাদের অনুকূলে সব মিলিয়ে ২৫ কোটি ২৯ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়েছে।
দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানুষ হতাহত হচ্ছে এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য তহবিলে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে, তার বিপরীতে প্রদান করা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ অনেক কম। বিষয়টি স্বীকার করেছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। তবে তাদের মতে, তহবিলে যে পরিমাণ অর্থ জমা আছে, ক্ষতিপূরণ প্রদান তার চেয়ে কম হওয়ার প্রধান কারণ হলো ৩০ দিনের সময়সীমা। কারণ নিয়ম অনুসারে দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করতে হয়।
আবেদনের সময়সীমা যদি যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়, তাহলে অতিসত্বর এ নিয়ম পরিবর্তন প্রয়োজন। একটা সড়ক দুর্ঘটনা কেবল আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই। মানবীয় গুণাবলি তথা আহত বা নিহত ব্যক্তির পরিবারের আবেগকে উপেক্ষা করা অনুচিত। শোকগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করার সময় বেঁধে দেয়া ভাবনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত বলে প্রতীয়মান হয় না। সুতরাং বিধিমালা সংশোধন আবশ্যক। বিআরটিএ বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছে। আশা করা যায় অনতিবিলম্বে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন হবে।
তবে ক্ষতিপূরণের পরিসর বাড়াতে কেবল বিধিমালা সংশোধন করলেই চলবে না, সড়ক দুর্ঘটনার খবরাখবর আজকাল হরহামেশাই গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। দুর্ঘটনায় আহত-নিহত ব্যক্তিদের তথ্যও সেসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া থানা ও হাসপাতালেও তথ্য থাকে। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের আহত ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া দরকার। আবেদনের জন্য বসে না থেকে সরকারের উচিত হতাহতদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়া।
অবশ্য এরই মধ্যে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সেবাটি আরো সহজ করতে ক্ষতিপূরণের আবেদন ও অর্থ সংগ্রহের জন্য আহত ব্যক্তি বা নিহতের স্বজনকে ঢাকায় আসতে হয় না। কারণ বিষয়টি জেলাভিত্তিক করা হয়েছে। এছাড়া গণমাধ্যমের সহযোগিতায় প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এছাড়া প্রচার-প্রচারণা আরো বাড়াতে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সেলফোনে এসএমএস পাঠানোর পরিকল্পনা করছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। তাদের এসব উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে একই সঙ্গে দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, চিকিৎসার ক্ষেত্রে পকেট ব্যয় ইত্যাদি বিবেচনায় ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণ বাড়ানো নিয়েও ভাবা দরকার।
সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২-এর আলোকে আহত ও নিহত ব্যক্তির পরিবারবেক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। ক্ষতিপূরণ দেয়ার ক্ষেত্রে ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে হিসাব ধরা হয়। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারির আগে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বিবেচ্য হবে না। পরিবহন বিধিমালা ২০২২ অনুযায়ী দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তার পরিমাণ নির্ধারণ করে ট্রাস্টি বোর্ড। দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কারো মৃত্যু হলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ এককালীন অন্যূন ৫ লাখ টাকা। দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে অন্যূন ৩ লাখ টাকা। গুরুতর আহত এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে অন্যূন ৩ লাখ টাকা। গুরুতর আহত এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে অন্যূন ১ লাখ টাকা।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম ব্যক্তির প্রাণ হারানোর কারণে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকার ক্ষতি হয়। তবে এর সঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরিবারের অন্যদের অর্থনৈতিক চাপ, কর্মক্ষেত্রের ক্ষতিসহ অন্যান্য বিষয় আমলে নেয়া হয়নি।
সে হিসাবে ক্ষতিপূরণের যে অর্থ তা যৎসামান্যই বটে। এর পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তা করা দরকার। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিআরটিএকে তহবিলে জমা থাকা অবশিষ্ট অর্থ যথাযথভাবে বিতরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এমনিতে দেশে তহবিল ব্যবস্থাপনা দুর্বল। সড়ক খাতের আর্থিক তহবিল ব্যবস্থাপনায় ট্রাস্টি বোর্ডকে অবশ্যই পেশাদার হতে হবে। ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।