৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সবার মাথায় হাত, শাবানা মালেকের বাজিমাত! স্বামী পলাতক, স্ত্রী বহাল তবিয়তে – সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দুর্নীতির সাম্রাজ্যে নতুন মোড়!

বিশেষ প্রতিনিধি :  মানিকগঞ্জ: সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক (স্বপন) পলাতক থাকলেও তার স্ত্রী শাবানা মালেক দেশে প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শুধু তাই নয়, গোপনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সহযোগিতা নিয়ে তিনি এখনো স্বামী-পুত্রের গড়ে তোলা ভয়াবহ দুর্নীতি সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, অবৈধ বালু ব্যবসা, টেন্ডার বাণিজ্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগে অভিযুক্ত এই পরিবারের ২৮টিরও বেশি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হলেও, শাবানা মালেকের অবাধ বিচরণ জনমনে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।
পরিবারতান্ত্রিক দুর্নীতির জাল: অনুসন্ধানে জানা যায়, মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে চারবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক ২০০৮ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন। পরবর্তীতে তিনি স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী এবং পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই জাহিদ মালেক ও তার অনুসারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে এলাকায় তারা গড়ে তোলেন দুর্নীতির এক বিশাল সাম্রাজ্য।

স্ত্রী শাবানা মালেকের চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট:
জাহিদ মালেকের ক্ষমতার দাপটে তার স্ত্রী শাবানা মালেক হয়ে উঠেন অর্থলোভী। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তিনি নিজেই গড়ে তোলেন পরিবহন চাঁদাবাজির এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। প্রথমে মানিকগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি বাবুল সরকারকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিদিন পরিবহন সেক্টর থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা তাকে দিতে হতো। পরবর্তীতে বাবুল সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, শাবানা মালেক ক্ষমতার প্রভাবে একাধিক স্কুলের সভাপতির পদও বাগিয়ে নেন।
পুত্র রাহাতের সন্ত্রাসী বাহিনী ও অবৈধ ব্যবসা:
বাবার প্রতাপে ছেলে রাহাত মালেক শুভ্র এলাকায় গড়ে তোলেন এক বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিফাত কৌরাইশি সুমন এবং ইরাদ কৌরাইশি ইমন—এই দুই ভাইয়ের মাধ্যমে রাহাত জেলায় তার আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি দখল করে নেন এলাকার অবৈধ বালু ব্যবসা এবং সাধারণ মানুষের শত শত বিঘা জমি। এমনকি সরকারি হাসপাতালে চাকরির বাণিজ্যও শুরু করেন রাহাত।

‘রাক্ষসী সিন্ডিকেট’ ও অবৈধ সম্পদের পাহাড়:
অভিযোগ উঠেছে, জাহিদ মালেক তার আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া উপজেলায় একটি ‘রাক্ষসী সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন তার ফুপাতো ভাই মানিকগঞ্জ সদর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইসরাফিল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক আফসার উদ্দিন সরকার, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক খান তুষার, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক সুলতানুল আজম খান আপেল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি বাবুল সরকার, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিফাত কৌরাইশি সুমন, ইরাদ কোরাইশি ইমন, সাটুরিয়ার হরগজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার ইসলাম জ্যোতি খান, সাটুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আফাজ উদ্দিন। এদের মাধ্যমে দুই উপজেলা জুড়ে দুর্নীতির রাজত্ব চালান জাহিদ মালেক।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরে জাহিদ মালেক তার পোষা সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে অবৈধভাবে জমি দখল, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, পরিবহনে চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য করে দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। মানিকগঞ্জের গড়পাড় গ্রামে তিনি নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, ছেলের নামে ‘শুভ্র সেন্টার’, খামার বাড়ি, মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে ‘কর্নেল মালেক টাওয়ার’, জাগীর শিল্প অঞ্চলে ‘কার্বন হোল্ডিংস লিমিটেড’ নামের কারখানা, সাটুরিয়ার নাহার গার্ডেন এলাকায় বিশাল কাঁচামালের আড়ত, এবং জাগীর ইউনিয়নের ঢাকুলীতে ৩১ বিঘা জমিও তার কব্জায়। এই জমি তিনি এসেনশিয়াল ড্রাগসের কাছে দুর্নীতির মাধ্যমে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভূমি দখল ও জোরপূর্বক অধিগ্রহণ:
জাহিদ মালেক তার ফুপাতো ভাই ইসরাফিল হোসেনকে দুইবার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। তার মাধ্যমেই তিনি অবৈধ বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, জাহিদ মালেক ও তার পরিবারের সদস্যরা এলাকায় শত শত বিঘা জমির মালিক হয়েছেন, যা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে জোরপূর্বক বা নামমাত্র মূল্যে লিখে নেওয়া হয়েছে। জমি লিখে না দিলে তাদের নামে মিথ্যা মামলাসহ হয়রানি করা হতো বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার ঢাকুলি গ্রামে সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগসের কারখানা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জাহিদ মালেক। এজন্য কেনা হয়েছিল সাড়ে ৩১ একর জমি। এসব জমির বেশির ভাগ জাহিদ মালেক নিজের প্রতিষ্ঠান এবং ছেলেমেয়ের নামে জোর করে লিখে নিয়েছিলেন। এরপর কৃষিজমিতে মাটি ভরাট করে মৌজা মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করেন, যাতে সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে চড়া মূল্য পাওয়া যায়।

বিলাসবহুল জীবনযাপন ও সম্পদের বিবরণ:
গড়পাড়া ঘোষের বাজার এলাকায় জাহিদ মালেক একটি বিশাল বাগানবাড়ি করেছেন। অভিযোগ আছে, সেখানে মায়ের নামে স্কুল করার কথা বলে স্থানীয়দের চাপ দিয়ে জমি নিয়েছেন। তার ক্ষমতার দাপটের কাছে এলাকার মানুষ ছিল অসহায়।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন, বিশাল বাগানবাড়ি, সভা-সেমিনারের জন্য ছেলের নামে ‘শুভ্র সেন্টার’, বনানীতে ১৪ তলা বিটিএ টাওয়ার, ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লটসহ ১৬ বছরে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন জাহিদ মালেক। হলফনামায় দেখা গেছে, ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকা পর্যন্ত জাহিদ মালেকের সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ।

সবার মাথায় হাত, শাবানা মালেকের বাজিমাত:
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ৫ আগস্ট থেকে পলাতক থাকলেও তার সন্ত্রাসী বাহিনী এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। তথ্য বলছে, জাহিদ মালেক ও তার ছেলে পলাতক থাকলেও তার স্ত্রী শাবানা মালেক এখনো দেশে রয়েছেন এবং তিনি প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনকি, তিনি গোপনে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সহযোগিতা নিয়ে এখনো সকল অপকর্ম পরিচালনা করছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। তাদের এই সিন্ডিকেট কীভাবে এত বছর ধরে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অপকর্ম চললেও কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তা নিয়েও তদন্তের দাবি উঠেছে। সাধারণ মানুষ এখন দেখছে, সবার মাথায় হাত দিয়ে শাবানা মালেক কীভাবে বহাল তবিয়তে তার সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।

মন্তব্য করুন