১৮ই জুন, ২০২৫

২০২৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি: ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য অমূল্য আত্মত্যাগের একটি দিন, যা আজও বাঙালির হৃদয়ে এক অবিস্মরণীয় দিন হয়ে রয়েছে। এই দিনটি ছিল বাঙালি জাতির ভাষা আন্দোলনের শিখর, যেখানে নিরপরাধ ছাত্ররা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সেই ঐতিহাসিক দিনে যারা জীবন দিয়েছিলেন, তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়, যা বিশ্বব্যাপী ভাষার অধিকার এবং সাংস্কৃতিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন, ২০২৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আসন্ন, এবং এ দিনটি আমাদের কাছে শুধু ভাষার মর্যাদা রক্ষার একটি মুহূর্ত নয়, বরং জাতীয় চেতনা ও আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বাঙালি জাতির সংগ্রামী চরিত্রের প্রতীক হয়ে রয়েছে, এবং আমরা এই চেতনাকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে আরও শক্তিশালীভাবে প্রচার করার দায়িত্বে রয়েছি।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস: ১৯৫২ সালের পটভূমি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালি ভাষাকে অবজ্ঞা করতে থাকে এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা শুরু করে। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বাঙালি জনগণ আন্দোলন শুরু করে, তবে এর জন্য বিশেষ কোনো সমর্থন না পাওয়ায় ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২, বাংলা ভাষার জন্য সড়কে নেমে আসে। পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে ছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, শফিক, জব্বার সহ আরও অনেকে। তাদের আত্মত্যাগ একদিনে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা এনে দেয় এবং বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

২০২৫ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রসঙ্গ
২০২৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পর, আমরা আবারও একই চেতনার কথা স্মরণ করি। তবে আজকের দিনে এই চেতনা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। একদিকে, আমরা একটি আধুনিক ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং তার সৃজনশীলতা নতুন মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলা এখন সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ডিজিটাল পত্রিকা, গুগল, ফেসবুক এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্মে সমানভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বাংলা ভাষা বিশ্বব্যাপী পৌঁছানোর সুযোগ পেয়েছে।
তবে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কিছু নতুন চ্যালেঞ্জও সামনে এসেছে। ইংরেজি ভাষার আধিপত্য, বাংলা ভাষার বিকৃত ব্যবহার, এবং কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে স্বয়ংক্রিয় বানান সংশোধন, যার ফলে অনেক সময় ভাষার সঠিক ব্যবহার হুমকির মুখে পড়ে। এর ফলে, ভাষা আন্দোলনের আদর্শ, ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, এবং বাংলাকে সংস্কৃতির প্রাণভোমরা হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।

নতুন প্রজন্মের ভাষা সচেতনতা
২০২৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আজকের তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি নতুন দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। যারা আধুনিক প্রযুক্তি, সোশ্যাল মিডিয়া, এবং বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ব্যবহার করে, তাদের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র একটি স্মরণীয় দিন নয়, এটি তাদের ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং আগ্রহ বৃদ্ধির একটি সুযোগ। এই প্রজন্মের কাছে, বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার এবং এর মর্যাদা রক্ষা করা শুধুমাত্র ভাষার একটি বাহক হিসেবে নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা, সেমিনার, কবিতা পাঠ ও ভাষা সচেতনতা কার্যক্রম চালানো যেতে পারে, যা তরুণ প্রজন্মকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করবে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: বাংলা ভাষার বৈশ্বিক মর্যাদা
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল বাঙালি জাতির একটি ঐতিহাসিক অর্জনই নয়, এটি এখন একটি আন্তর্জাতিক চেতনা হিসেবে পালিত হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার পর, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। এই দিবসটি পৃথিবীজুড়ে ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষায় সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
উপসংহার ২০২৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পর, আমাদের কাছে একটি আবহমান দিনের বার্তা রয়েছে, তা হলো ভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা এবং তার সঠিক ব্যবহার বজায় রাখা। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আজকের দিনে শুধু আমাদের কৃতজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দেয় না, বরং এটি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে অনুপ্রাণিত করে। ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং তার বিকাশে প্রতিটি বাঙালি, বিশেষত তরুণরা, নিজেদের ভূমিকা পালন করবে, এমন প্রত্যাশা নিয়ে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করি।

তথ্য সংগ্রহ : উইকিপিডিয়া, এবং ইতিহাসের পাতা থেকে ।
লেখক : কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন (অব.) : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, লেখক ও কলামিস্ট, প্রাক্তন পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ, প্রকল্প পরিচালক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর । বর্তমানে রাজধানীর একটি স্বনামধন্য কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন।

 

খবরের আলো/কর্নেল কাজী শরীফ উদ্দিন (অব:)

মন্তব্য করুন