১৮ই জুন, ২০২৫

মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা: যুবসমাজের বিপর্যয় রোধে জরুরি পদক্ষেপের দাবি

মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা: যুবসমাজের বিপর্যয় রোধে জরুরি পদক্ষেপের দাবি
ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার ক্রমশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এর ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারি পদক্ষেপ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান সত্ত্বেও মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা এবং এর ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে এ সমস্যাটি ভবিষ্যতে আরও জটিল রূপ ধারণ করবে।

মাদকের বাজার ও প্রবণতা
বাংলাদেশে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন এবং সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিস্টাল মেথ (আইস) নামক একটি নতুন মাদকের প্রচলন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত ইয়াবার চাহিদা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালে ইয়াবার চালানগুলো আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

মাদকের চাহিদার মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করছে দেশের বড় শহরগুলো। মাদক চোরাচালানকারীরা বিশেষত রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, এবং সিলেটের তরুণদের লক্ষ্য করে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এই মাদক ব্যবহারের ফলে কেবল অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে না, বরং তরুণ প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

একজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারের পর জানা যায়, তাদের নেটওয়ার্ক সারা দেশে বিস্তৃত। ঢাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া এক অভিযুক্ত জানান, “আমরা মূলত সীমান্ত এলাকা থেকে মাদক সংগ্রহ করি এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে সরবরাহ করি। প্রতিদিন নতুন নতুন পথ বের করি, যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহজে ধরতে না পারে।”

তরুণদের মাদকাসক্তির কারণ
বাংলাদেশে মাদকাসক্তি বেড়ে যাওয়ার পিছনে বেশ কয়েকটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। বেকারত্ব, হতাশা, পারিবারিক সমস্যা এবং সামাজিক চাপ তরুণদের মাদক গ্রহণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও মাদক সহজলভ্য হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা সহজেই এতে জড়িয়ে পড়ছে।

একজন মাদকাসক্ত তরুণ বলেন, “আমার বন্ধুদের সঙ্গে প্রথমে ইয়াবা খাই। তখন মনে হয়েছিল মজা করার জন্য। পরে আমি আসক্ত হয়ে যাই এবং ধীরে ধীরে পুরো জীবনটাই মাদকের পিছনে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছি, কিন্তু খুব কঠিন হচ্ছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. নুসরাত জাহান বলেন, “মাদকাসক্ত তরুণদের বেশিরভাগই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন। তাদের মধ্যে হতাশা, বিষণ্ণতা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে, যা তাদেরকে মাদকের দিকে টেনে নিয়ে যায়।”

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ পুলিশ এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) মাদক নির্মূল করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে মাদক চোরাচালানকারীদের গ্রেফতার করা হলেও এই সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আসা মাদক সরবরাহ বন্ধ করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও মাদক পাচারকারীদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, “আমরা প্রতিদিন সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালাই। তবে মাদক চোরাচালানকারীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছে। সীমান্ত রক্ষা করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে যখন পাচারকারীদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিও জড়িত থাকে।”

পুনর্বাসন ও প্রতিরোধমূলক উদ্যোগের অভাব
মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশের সরকারি উদ্যোগগুলোর সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের সংখ্যা সীমিত এবং প্রায়ই সেখানে সঠিক সেবার অভাব থাকে। চিকিৎসা প্রাপ্তির পরও অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তি পুনরায় মাদক ব্যবহারের দিকে ফিরে যায়, কারণ সমাজে পুনর্বাসিত হওয়ার যথাযথ পরিবেশ তারা পায় না।

বাংলাদেশের মাদকবিরোধী আন্দোলনের কর্মী রোকসানা বেগম বলেন, “মাদকাসক্তদের পুনর্বাসন করতে হলে পরিবার ও সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তরুণদের মানসিক সাপোর্ট এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে।”

পরামর্শ ও সমাধান
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদী ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। একদিকে যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে, তেমনি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদক নির্মূল করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনকে এগিয়ে আসতে হবে।


গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:

  • মাদক ব্যবসার বিস্তার: ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, আইস।
  • সীমান্ত থেকে মাদক প্রবেশের রুট: মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত।
  • যুবসমাজের মধ্যে মাদক সেবনের কারণ: হতাশা, বেকারত্ব, পারিবারিক সমস্যা।
  • পুনর্বাসনের অভাব এবং পুনর্বাসিতদের পুনরায় মাদকাসক্ত হওয়ার প্রবণতা।

মন্তব্য করুন