*দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকায় মিলছে চিকিৎসার ছাড়পত্র
*দুইদিন ঘুরেও পাওয়া যায়নি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
*জেলা সমাজসেবা অফিসার দ্বায় চাপালেন বাস্তবায়ন কমিটির ঘাড়ে
* দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দাবি করেন সচেতন মহল
আহসান হাবিব মিলন
১৯৭১সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা (রাজাকারী) করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আহত হয়ে অনেকেই যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে সফল ভাবে সুবিধা ভোগ করে-মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা কলঙ্কিত করেছে।
ঠিক তেমনি ভাবে এবারেও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকার পতনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় আহত না হয়েও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ভুয়া সনদ নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের দেয়া ১লাখ টাকা প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ পেতেছেন অনেক প্রতারক। অভিযোগ উঠেছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কিছু কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ মদতে কথিত দালাল চক্রের লোকজন এই ছাড়পত্র ২ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন প্রতারকদের কাছে। আর সেই ছাড়পত্র যাচাই বাছাই না করেই ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাসহ সমাজ সেবার কর্মকর্তারা তাদের তালিকা প্রণয়ন করে অনেক প্রতারকদের ১০টাকা করে অনুদান দিয়েছে। এতে নিষ্পেষিত আহতরা অনেকেই হয়েছেন বঞ্চিত।
এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার ভিত্তিতে অনুসন্ধানে দেখাগেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা অন্তবর্তীকালীন সরকার দেয়ার পর থেকেই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গুলোতে ভূয়া ছাড়পত্র (এমসি) নিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন প্রতারক’রা।
এরই মধ্যে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দালাল চক্রের সহযোগিতায় প্রায় দুই থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে শতাধিক ভূয়া আহতের ছাড়পত্র সংগ্রহ করেছে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার প্রতারক চক্র। এছাড়া উপজেলার হাসপাতালগুলো থেকেও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ও সমন্বয়ক পরিচয়ে অর্থের বিনিময়ে ভূয়া আহতের ছাড়পত্র সংগ্রহ করে সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রণোদনা হাতিয়ে নিয়েছে অনেকেই।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত ১৬ জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত ১২২ জন আহত আন্দোলনকারী চিকিৎসা নিয়ে থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত আহতদের প্রণোদনার তালিকায় নাম উঠেছে ভুয়া ছাড়পত্র সংগ্রহ করা ব্যক্তিদের। এবং হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সিল স্বাক্ষর জাল করা ছাড়পত্র দিয়ে প্রণোদনা পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সচেতন মহলে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে জানাগেছে,রংপুর জেলার সমস্ত আহতদের ছাড়পত্র যাচাই বাছাই করলে শতাধিক ভূয়া আহত বেড়িয়ে আসবে।
এছাড়াও সমন্বয়ক দাবি করে ছাড়পত্র জোর পূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছে অনেক প্রতারক,যা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সর্দার অফিসের দেয়া ছাড়পত্র মোতাবেক রেজিস্ট্রার খাতায় এন্ট্রি করা হয় নাই। অনুসন্ধানে প্রতিবেদককে ৭ জন ভূয়া আহত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করে ওয়ার্ড মাষ্টার মানিক সরকার বলেন,যারা টাকার বিনিময়ে ছাড়পত্র নিয়েছে মেডিকেল এর রেজিস্টার খাতায় তাদের পরিচয় থাকবে প্রতারকের তালিকায়।
এদিকে ভূয়া আহতের ছাড়পত্র (এমসি) সংগ্রহ করে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া ব্যক্তি পীরগাছার ছাওলা ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক পরিচয় দেয়া আসাদুজ্জামান আসাদ প্রতিবেদক এর কাছে অকপটে ভুয়া চিকিৎসা পত্র সংগ্রহ করার বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন,গত ১৯ জুলাই রংপুর পুলিশ লাইন্সের সামনে বিকাল ৫ টার সময় ছাত্রদল যুবদলের সঙ্গে মিছিলে গিয়ে মাথায়,পিঠে ও চড়ুতে ১৯ টি ছররা গুলিতে আহত হই এবং পরবর্তীতে স্থানীয় ব্রাম্মীকুন্ডা বাজারের পল্লী চিকিৎসকের কাছে গুলিগুলো বের করে নেয়ার পর পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে পল্লী চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে ছাড়পত্র বানিয়ে নিয়েছি। এবিষয়ে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান অবগত আছে। আমি নগদ দশ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতাও পেয়েছি।
তারই পার্শ্ববর্তী উপজেলা কাউনিয়া টেপামধুপুর এলাকার বাসিন্দা ভুয়া ছাড়পত্র নেয়া মাইদুল ইসলাম জানান, গত ১৯ তারিখে আমার কপালে গুলি একদিকে লেগে আরেকদিকে বের হয়ে গিয়েছিলো। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর ধরাধরি করে স্থানীয়রা আমাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছিলো। গুলি কপালে একদিকে লেগে আরেকদিকে বের হওয়ার পরও কিভাবে বেঁচে গেলেন। এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভাই আমার সেসময়ে জ্ঞান ছিলো নাহ। কি গুলি লেগেছিলো সেটাও জানি নাহ। আমি কোন ভূয়া ছাড়পত্র নেইনি। রেজিস্ট্রারে কেন নাম লিপিবদ্ধ হয়নি সেবিষয়ে কিছুই জানিনা তবে প্রণোদনা পেয়েছি দশহাজার আরো এক লাখ টাকা দিবে সরকার।
এছাড়াও গঙ্গাচড়া উপজেলার নাজমুল হাসান লিখন, বদরগঞ্জ উপজেলার জোবায়ের আলম, মিঠাপুকুর উপজেলার নিখিল চন্দ্র রায় গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলামসহ একাধিক ব্যক্তি ভুয়া ছাড়পত্র সংগ্রহ করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ পেতেছেন।
ছাড়পত্র যাচাই বাছাই না করে কিভাবে পীরগাছা ছাওলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নাজির হোসেন আসাদুল ইসলামের ভুয়া কাগজপত্রে সুপারিশ করলেন, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান নাজির হোসেন বলেন,বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমার ইউনিয়নে আব্দুল হাকিম, আসাদুল ইসলাম আসাদসহ মোট চারজন আহত হয়েছিলো । এর মধ্যে আব্দুল হাকিম সবচাইতে বেশি আহত হয়েছিলো ঢাকায়। তারা প্রত্যেকেই সরকারি তালিকা ভুক্ত এবং আমার পরিবারের লোকজন বলে জানান তিনি।
তবে দশহাজার করে অনুদান পাওয়া ব্যক্তিদের নাম রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার খাতায় পাওয়া যায়নি।
এদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুর মহানগরীর হনুমানতলার বাসিন্দা ও পায়রা চত্বরের মকবুল হোটেলের বাবুর্চি মকবুল হোসেন (৬৫) আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আমার শরীরে প্রায় দেড় শতাধিক ছড়া গুলি লাগে এখন পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তা পাইনি, অথচ মানুষ মারফত জানতে পারি অনেকেই ভুয়া ছাড়পত্র নিয়ে সরকারি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এবিষয়ে রংপুর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ পরিচালক আব্দুল মতিন জানান, আমরা রংপুর মেডিকেলের রোগী কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ১৫ জনকে চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছি জেলা কার্যালয় থেকে। উপজেলা পর্যায়ে দশ হাজার টাকা করে যে আর্থিক সহযোগিতা দেয়া হয়েছে এটি সমাজসেবা কার্যালয়ের গতানুগতিক আর্থিক সহযোগিতার একটি অংশ। আমরা আহতদের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোন আলাদা বরাদ্দ পাইনি। উপজেলা পর্যায়ে ভূয়া আহতদের ছাড়পত্রের বিষয়ে তিনি জানান, এটি যাছাই বাছাই করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সমাজসেবা অফিসারসহ উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটির। ভূয়া আহতের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি আমার জানা নেই।
ভুয়া ছাড়পত্র বা সনদধারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে রিপোর্টার্স ক্লাব রংপুর এর সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান লুলু, সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুল হালিম আনসারী ও বিশিষ্ট সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ আলাউদ্দিন মিয়া প্রতিবেদককে বলেন, যারা এই ভুয়া ছাড়পত্র নিয়ে সরকারি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে,তারা দেশের শত্রু, এদের ব্যাপারে এখনি আইনি ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এ সংক্রান্ত বিষয় গুলো জটিলতা সৃষ্টি করবে। যেমনটি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, যুদ্ধাহত রাজাকার হয়েছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়াও এ বিষয়গুলো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ যথাযথ আইনি ব্যবস্থা না নিলে সরকার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্তসহ প্রকৃত আহতদের ইতিহাস বিকৃতি ঘটবে।
এ সংক্রান্ত বিষয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই দিন ঘুরেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল জানান, আমরা রংপুর জেলায় এখনো আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করিনি। ভূয়া ছাড়পত্র দিয়ে কেউ যদি সমাজসেবা থেকে টাকা উত্তোলন করে থাকে, তাদের নামসহ নির্দিষ্টভাবে জানালে আমরা যাছাই বাছাই করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তবে অর্থের বিনিময়ে ভূয়া ছাড়পত্র বিক্রির বিষয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখবে।